বাংলার ইতিহাস ও জনপদের আদ্যপান্ত |
ইতিহাসের উপাদান
ঐতিহাসিক সত্য কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যবহৃত তথ্যপ্রমাণ বা যে কোন ভিত্তি ইতিহাসের উপাদান। ইতিহাসের উপাদান দুটি ভাগে বিভক্ত:- লিখিত উপাদান
- অলিখিত উপাদান।
লিখিত উপাদান
লিখিত উপাদানে রয়েছে দলিলপত্র, সাহিত্য, বৈদেশিক বিবরণ ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’, মহিদাসের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’, গোলাম হোসেন সলিমের ‘রিয়াজ আস সালাতিন’ ইত্যাদি।‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ‘আকবরনামা’ নামে তিন খণ্ডের বিশাল ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। আইন-ই-আকবরী হল আকবরনামার তৃতীয় খন্ডের নাম। এই খণ্ডে আবুল ফজল দেশবাচক বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তি দেখিয়ে বলেছেন প্রাচীন নাম ‘বঙ্গ’ এর সাথে বাধ বা জমির সীমানা সূচক ‘আইল; (-আলি, আইল) প্রত্যয় যোগে ‘বাংলা’ শব্দ গঠিত হয়।
তৎকালীন কিছু তথ্য বিভিন্ন বিদেশি সাহিত্যকর্মেও পাওয়া যায়। যেমন, চৈনিক ইতিহাসের জনক সিমা কিয়ান রচিত ‘খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ইতিহাস’ গ্রন্থখানি ভারতীয় ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। ফারসি ভাষায রচিত মিনহাজ-উস-সিরাজের ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা ইতিহাস পুনর্গঠন এর অন্যতম গ্রন্থ।
অলিখিত উপাদান
যেসব বস্তু বা উপাদান থেকে আমরা বিশেষ সময়, স্থান বা ব্যক্তি সম্পর্কের বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাই তাকে অলিখিত উপাদান বলে। যেমন- মুদ্রা, শিলালিপি, স্তম্ভলিপি, তাম্রলিপি, ইমারত ইত্যাদি। প্রাচীনকালে তামার পাত খোদাইয়ের মাধ্যমে রাজাগণ কর্তৃক নির্দেশগুলোই তাম্রশাসন নামে অভিহিত। স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য এরকম ৭ টি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে।
পরিব্রাজক
পরিব্রাজক হল পর্যটক। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ সর্বদাই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে পরিব্রাজকদের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ
মেগাস্থিনিস
প্রাচীন গ্রিসের একজন পরিব্রাজক। ক্রিক সেলিউকাস খ্রিষ্টপূর্ব ৩০২ অব্দে মেগাস্থিনিস কে দূত হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে প্রেরণ করেন। তিনি কয়েক বছর এদেশে অবস্থান করে মৌর্য শাসন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ‘ইন্ডিকা’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।
ফা-হিয়েন
একজন চৈনিক তীর্থযাত্রী। তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক মধ্যে তিনি প্রথম ভারতে আসেন। ফা-হিয়েন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীন থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৪ বছর পর আবার চীনে ফিরে যান। ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে তিনি সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ৭ টি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ‘ফো-কুয়ো-কিং’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
হিউয়েন সাং
একজন চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী। তিনি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সফরে আসেন। তিনি প্রায় ১৪ বছর ভারতে অবস্থান করেন। হর্ষবর্ধনের দরবারে ৮ বছর (৬৩৫-৬৪৩ খ্রি.) কাটান। হিউয়েন সাং নালন্দা মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শীলভদ্রের কাছে বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি ‘সিদ্ধি’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ইবনে বতুতা
১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোয় জন্মগ্রহণ করেন ইবনে বাতুতা। তিনি ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে ২১ বছর বয়সে বিশ্ব সফরে বের হন। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি সিন্ধুর পাঞ্জাবে পৌঁছান। ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লিতে আসেন। সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক তাকে দিল্লির কাজী নিযুক্ত করেন। প্রায় আট বছর তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।
ইবনে বতুতা ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ এর রাজত্বকালে বাংলায় আসেন। বাংলার যে শহরে ইবনে বতুতা প্রথম পৌঁছান (৯ জুলাই, ১৩৪৬) তার নাম তিনি উল্লেখ করেন চাটগাঁও (চট্টগ্রাম)। এরপর তিনি বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে সিলেটে যান। তিনি সিলেট থেকে নদীপথে সোনারগাঁও (১৮ আগস্ট, ১৩৪৬) আসেন। ইবনে বতুতার ‘কিতাবুল রেহেলা’ (বা সফরনামা) নামক গ্রন্থে বাংলায় অপরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়।
প্রথম বিদেশি পর্যটক হিসেবে তিনি ‘বাঙ্গালা’ শব্দ ব্যবহার করেন। জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যাদির প্রাচুর্য ও স্বল্প মূল্য আর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ইবনে বতুতা কে আকৃষ্ট করলেও এদেশের আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি। এজন্য তিনি বাংলাদেশের নামকরণ করেন ‘দোযখ ই পুর নিয়ামত’ বা প্রাচুর্যপূর্ণ নরক।
মা-হুয়ান
একজন চৈনিক পরিব্রাজক। তিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক এক প্রতিনিধি দোভাষী হিসেবে বাংলায় আসেন। মা-হুয়ান সোনারগাঁও কে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহর রূপে প্রত্যক্ষ করেন। বাংলা সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ ‘ইঙ্গ ইয়াই শেং লান’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।
এক নজরে উপমহাদেশে পরিব্রাজকগণের আগমনকাল
পরিব্রাজকের নাম |
দেশ |
ভারতে আগমন |
বাংলায় আগমন |
মেগাস্থিনিস | গ্রিস | খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ | x |
ফা-হিয়েন | চীন | পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে | পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে |
হিউয়েন সাং | চীন | ৬৩০ খ্রি. | ৬৩৮ খ্রি. |
ইবনে বতুতা | মরক্কো | ১৩৩৩ খ্রি. | ১৩৪৬ খ্রি. |
মা হুয়ান | চীন | x | ১৪০৬ খ্রি. |
বাঙালি জাতির উৎপত্তি
সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাক-আর্য (অনার্য) জনগোষ্ঠী এবং আরো জনগোষ্ঠী। আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় এই চারটি শাখায় বিভক্ত ছিল। নিগ্রোদের মত দেহযুক্ত এক আদিম জাতি এদেশে বসবাস করত। এরাই ভীল, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতির পূর্বপুরুষ।
অস্ট্রিক জাতি থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ তাদের ‘নিষাদ জাতি’ বলে থাকেন। প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি নেগ্রিটোদের উৎখাত করে।
অস্ট্রিক জাতির সমকালীন (প্রায় ৫০০০ বছর আগে) দ্রাবিড় জাতি (দক্ষিণ ভারতের আদিবাসী) বাংলায় আসে ও উন্নত সভ্যতার হওয়ায় তারা অস্ট্রিক সভ্যতা ধ্বংস করে। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশে আর্যকরণের পরেই এরা আসে বলে বাঙালির রক্তে এদের মিশ্রণ উল্লেখযোগ্য নয়। গারো, কোচ, ত্রিপুরা, চাকমা জাতি এসে সংযুক্ত হয়ে গড়ে তুলেছে বাঙালি জাতি। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ।
আর্যদের আদিনিবাস ছিল ইউরাল পর্বতে দক্ষিণে বর্তমান মধ্য এশিয়া- ইরানে।ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব 200 অফ অব্দে। সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের বা তার কিছু আগে আর্যরা বাংলায় আসতে শুরু করে। আর্যরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে সেমীয় গোত্রের আরবীয়রা ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। তাদের অনুকরণে নেগ্রিটো রক্তবাহী হাবশিরাও এদেশে আসে। এমনিভাবে অন্তত দেড় হাজার বছরের অনুশীলন, গ্রহণ, বর্জন এবং রুপান্তিকরণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি গড়ে ওঠে। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত আদি অস্ট্রেলীয় (Proto Australian) গোষ্ঠীভুক্ত।
বাংলার প্রাচীন জনপদ
সাহিত্য গ্রন্থ সাহিত্য গ্রন্থ ও উৎকর্ণ শিলালিপি হতে প্রায় ষোলটি জনপদের কথা আমরা জানতে পারি, যেসব জনপদের মধ্যে দিয়ে বাংলার জন্ম।
পুন্ড্র
প্রাচীনতম জনপদ হলো পুন্ড্র।
বঙ্গ
গঙ্গা নদীর ভাগীরথী ও পদ্মা স্রোতধারার মধ্যে অবস্থিত ত্রিভুজের ভূখন্ডটি বঙ্গ। বাংলাদেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশে কিছু অঞ্চল জুড়ে এই জনপদ ছিল। বঙ্গ থেকেই বাঙালি জাতির উৎপত্তি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারত যখন আলেকজান্ডার কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়, তখন গঙ্গারিডাই নামের একটি রাজ্য বাংলাদেশ ছিল। অনেক ক্লাসিক্যাল লেখক বঙ্গকেই গঙ্গারিডাই বলে। এই রাজ্যের ঘটনা শুনে আলেকজান্ডার শঙ্কিত হয়ে যায় এবং যমুনা পশ্চিম পাড় থেকে ফিরে যায়।
হরিকেল
পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন এই জনপদ আধুনিক সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সমতট
বঙ্গের এই প্রতিবেশী জনপদ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় অবস্থিত। সমতট অঞ্চলটি মূলত গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব থেকে মেঘনা মোহনা পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড়কামতা নামক স্থান এই জনপদের রাজধানী। ময়নামতিতে পাওয়া কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন এর মধ্যে শালবনবিহার অন্যতম।
বরেন্দ্র
উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ বরেন্দ্রভূমি।
তাম্রলিপ্ত
এই জনপদ হরিকেল জনপদের দক্ষিণে অবস্থিত। বর্তমান মেদিনীপুর জেলা তমলুকই পূর্বে তাম্রলিপ্ত জনপদ ছিল।
চন্দ্রদ্বীপ
বরিশাল জেলার বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তীস্থানে এই জনপদের মূল ভূখণ্ড অবস্থিত ছিল।
এক নজরে প্রাচীন জনপদ ও এর বর্তমান অবস্থান
পুন্ড্র
বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর।
বরেন্দ্র
রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল।
সমতট
বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী
বঙ্গ
বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর।
গৌড়
মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
হরিকেল
সিলেট, চট্টগ্রাম।