ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস |
“মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে
কতই শান্তি ভালোবাসা।
আ-মরি বাংলা ভাষা”
১৯৪৭
পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬.৪% লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। আর মাত্র ৩.৩ শতাংশ লোকের মুখের ভাষা ছিল উর্দু। এই পরিস্থিতিতে দেশভাগের (ভারতবর্ষ) পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন ওঠে।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ ও চৌধুরী খালেকুজ্জামান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক এবং আরো কয়েকজন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসময় এক ভাষণে বলেছিলেন ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’।
১ সেপ্টেম্বর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ গড়ে ওঠে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে এই সাংস্কৃতিক সংগঠন।
১৫ সেপ্টেম্বর
ভাষা আন্দোলনের প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ তমুদ্দিন মজলিস সংগঠন হতে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের লেখক ছিলেন তিনজন, অধ্যাপক আবুল কাসেম, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদ।
১৯৪৮
ঢাকায় জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি
পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশন কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। কিন্তু গণপরিষদ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহল অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে।
২ মার্চ
মার্চের প্রথম সপ্তাহের এই দিনে কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।
১১ মার্চ
এই পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র ব্যাহত করার জন্য সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঢাকায় অনেক ছাত্র আহত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। এজন্য ১৯৪৮-৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় কালে প্রতিবছর ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালন করা হয়।
২১ মার্চ
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী ময়দান) এক জনসভায় ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।
২৪ মার্চ
১৯৪৯
পূর্ববাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ।
১৯৫০
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে’।
১৯৫২
২৬ জানুয়ারি
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সেদিন আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব।
৩১ জানুয়ারি
আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) রোজ বৃহস্পতিবার ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের এবং সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০ ফেব্রুয়ারি
ছাত্র আন্দোলনের তোপে ভীত সন্তস্ত্র হয়ে নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা, সমাবেশ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে।
২১ ফেব্রুয়ারি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে মিলিত হয়। তখন উপস্থিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও সেই সময় ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
সেদিন মিছিলে অংশ নেয়া রফিক উদ্দিন পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়। তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। পুলিশের গুলিতে আরও শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বার এমং আরো অনেকে। ৯ বছরের শিশু ওহিউল্লাহও সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি
ঠিক পরের দিন পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রার উপরে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে, যাতে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
এই আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন মালিক গোলাম মোহাম্মদ, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আমিন।
১৯৫৪
৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৫৬
১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদিত হয়। এর মাধ্যমে অব্যাহত ভাষা আন্দোলন তার লক্ষ্যমাত্রা অর্থ অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে এর সদস্য ফরিদপুরের আদেলউদ্দিন আহমেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৮৭
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য আইন পাশ হয়।
১৯৯৯
১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৩০-তম সাধারণ অধিবেশনে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ও লেখক
- ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘ভাষা সৈনিক’
- মাহবুবুল আলমের বিখ্যাত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’
- ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ (একুশের প্রথম গান), রচয়িতা ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজীউল হক।
- ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থের সম্পাদক- হাসান হাফিজুর রহমান।
- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির গীতিকার- আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও সুরকার- আলতাফ মাহমুদ।
- ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিখ্যাত নাটকের নাম ‘কবর’, লেখক মুনীর চৌধুরী।
শহীদ মিনার
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
১৯৫২
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। এটি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থিত। এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঠিক সেদিন সকালে শহীদ শফিউরের পিতা শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। কিন্তু পুলিশ ও সেনাবাহিনী ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে।
১৯৫৭-৫৮
শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণের একাংশে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। হামিদুর রহমানের সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমদ। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনার তৈরি কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬২-৬৩
মূল নকশার বহুলাংশে পরিবর্তন করে নতুন নকশা দাঁড় করানো হয়। এই নকশা অনুযায়ী শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয় এবং হাজার ১৯৬৩ সালে এই মিনার উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।
১৯৭১-৭২
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনার নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু এবারও মূল নকশা পরিহার করে ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত নকশার ভিত্তিতেই দ্রুত নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়।
অন্যান্য শহীদ মিনার
- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার (৭১ ফুট) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত।
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশা করেন শিল্পী মুর্তজা বশীর।
- বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে বহির্বিশ্বে প্রথম ‘শহীদ মিনার’ নির্মিত হয় ১৯৯৭ সালের যুক্তরাজ্যের ওল্ডহ্যামে ও দ্বিতীয়টি নির্মাণ হয় ১৯৯৯ সালের লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে।
- বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বহির্বিশ্বে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় জাপানের টোকিওতে ( ২০০৫ সালে)। এছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্ত্রাষ্ট্রের টেক্সাস শহরে নির্মিত হয়েছে স্থায়ী শহীদ মিনার।
ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য
ভাস্কর্য | স্থপতি | অবস্থান |
মোদের গরব | অখিল পাল | বাংলা একাডেমি চত্বর |
অমর একুশে | জাহানারা পারভীন | জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় |